১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধানরা মনে করলেন যেভাবে দেশ পরিচালিত হচ্ছে তা ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না। আমরা দেখি অল্প সময়ের মধ্যেই সামরিক শাসনের নামে স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়ে যায়। প্রথমে সেনা প্রশাসক পরে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। একই কায়দায় হু.মু এরশাদও হাজারটা ফিরিস্তি দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ নিম্নোক্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলেন।
“আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ, সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য ও করুণায় এবং আমাদের মহান দেশপ্রেমিক জনগণের দোয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ বুধবার থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সকল ও পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করছি এবং ঘোষণা করছি যে গোটা বাংলাদেশ অবিলম্বে সামরিক আইনের আওতায় আসবে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আমি বাংলাদেশের সকল সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছি।”
স্বৈরাচারি কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু হলো। এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেই জাতির মেরুদন্ড ভাঙ্গার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন কারণ এরশাদ জানতেন শিক্ষাই হলো জাতির মেরুদন্ড। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাতি যেন কোন প্রতিবাদ করতে না পারে সেজন্যই প্রথমেই তিনি শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৬ই জুলাই ১৯৮২ ইং তারিখে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সদস্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি জানান যে তার সরকার একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে। যা দেশের শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে এবং ভবিষ্যৎ জাতির সন্তানদের চরিত্র গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সেই সভাতেই তিনি শিক্ষার মানোন্নয়নে নিজে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করেন এর কিছুদিন পরেই তিনি এই সংগঠনের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন। শিক্ষক না হয়েও পৃথিবীর আর কেউ কোনোদিন কোন শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন কিনা তা আমার জানা নেই।
ক্ষমতা গ্রহণ করেই এরশাদ সরকার সারাদেশে প্রকাশ্যে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পাশাপাশি কেউ তার সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করলে তার সাত বছরের কারাদন্ড হয়। সে সময় ওই সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন অতীতের মতো করেই ছাত্ররা। প্রথম মিছিলটি বের করে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।
এদিকে স্বৈরাচার সরকারের সুযোগ্য শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর নতুন একটি শিক্ষানীতির প্রস্তাব পেশ করেন। ক্ষমতায় ঠিকে থাকার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে প্রথম শ্রেণী থেকেই ধর্ম শিক্ষা ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকেই ইংরেজী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়। আর তিনি উচ্চ শিক্ষার মান নির্ধারণ করেন পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা থাকতে হবে, না হলে কেউ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে না। তৎকালীন শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা এই শিক্ষানীতিকে পাকিস্তানের স্বৈরাশাসক আইয়ুব খানের শরিফ শিক্ষা কমিশনের নবায়ন ভিন্ন সংস্করণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
সারাদেশের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ এই শিক্ষানীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। শুরু হয় রাজপথে শিক্ষাকে বাঁচানোর লড়াই-সংগ্রামের, শুরু হয় মিছিল প্রতিবাদ। ১৯৮২ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের লাঠিপেটায় গুরুতর আহত হন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক নূরুল আমিন বেপারীসহ ছাত্র, কর্মচারী ও সাংবাদিকগণ। সেই সাথে গ্রেফতার করা হয় ৩০ জনকে। এর প্রতিবাদে পরের দিন সারাদেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিছিল, সমাবেশ ও ধর্মঘট। বন্ধ করে দেওয়া হয় ছাত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৮২ সালের ১৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় খোলে দিলে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, ছাত্রলীগ ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ ১৪টি ছাত্র সংগঠন একযোগে আন্দোলন কর্মসূচী চালায়। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির আলাদা আলাদা কর্মসূচী পালন করে। একদিকে চলে সারাদেশে ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলন আর অন্যদিকে দমন নিপীড়ন চলতে থাকে। ছাত্ররা ২৯ ডিসেম্বর দাবি দিবস ও ১১ জানুয়ারী সচিবালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচী ঘোষণা করে।
এত আন্দোলনের পরও কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ তাতে একটুও না থেমে ১৯৮৩ এর জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশের ১৪২টি থানার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধ্যতামূলক আরবি শিক্ষা শুরুর আদেশ দেন। একই সাথে ১১ জানুয়ারীর অবস্থান কর্মসূচীর বিরুদ্ধে কড়া প্রেসনোট হুমকি দেয়। কিন্তু তাতেও ছাত্ররা দমে না গেলে এরশাদ ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দেয়। ছাত্ররা ৭ জানুয়ারী ১৯৮৩ সালের সেই প্রস্তাবিত বৈঠক প্রত্যাখ্যান করে।
সেই সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করে- “শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষায় অতিরিক্ত দুইটি বিদেশী ভাষা বাধ্যতামূলক করিয়া মূলত বাংলা ভাষাকে আঘাত করা হইয়াছে। শিক্ষা সংস্কারের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাজীবনে এক অরাজক ও নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি করা হইতেছে এবং উচ্চ শ্রেণীর ব্যয়বহুল বিনিয়োগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলিতেছে। ছাত্র সমাজের উপর চলিতেছে চাপ ও নিপীড়ন। এই পরিস্থিতিতে সংগ্রাম পরিষদ শিক্ষা, গণতন্ত্র ও মৌল অধিকারসহ শোষণমুক্তির দাবি লইয়া একুশে ফেব্রুয়ারী পালনের আহ্বাণ জানায়।”
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এই ঘোষণার বিপরীতে সরকারী প্রেসনোটে বলা হয়- “গত নভেম্বর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেসব গণবিরোধী ও সমাজবিরোধী ঘটনা ঘটছে সরকার তা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করে আসছেন। সরকার এসব বিপথগামী ব্যক্তিদের ধ্বংসাত্মক পথ পরিত্যাগ করার জন্য হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন। অন্যথায় তাদের গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।”
ছাত্রদের পূর্বঘোষিত ১১ জানুয়ারী তারিখে হাজার হাজার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে সমবেত হয়।
অপরদিকে অস্ত্রসজ্জিত প্রচুর দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ের চারপাশে। ব্যাপক সংঘর্ষ এড়াতে ছাত্ররা সচিবালয় না গিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে আন্দোলন তীব্রতর করার শপথ গ্রহণ করেন। একুশে ফেব্রুয়ারীকে ঘিরে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে, আর তখনই এরশাদ একুশের চেতনায় আঘাত হানতে শুরু করে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে এরশাদ সরকার ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করে। এ জন্যই জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেসিন আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এরশাদ বলেন, “বাংলাদেশ মুসলমানদের দেশ, বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল শহীদ মিনার। কিন্তু আমরা দেখি সেখানে আল্পনা আঁকা হয়। এ কাজ ইসলাম বিরোধী। শহীদ আবুল বরকত আল্লাহর বান্দা, তার জন্য আল্পনা কেন, কোরানখানি হবে। গত ২৪ মার্চ আমি দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। কিন্তু সেদিন আমি আল্লাহর কাছে হাত তুলে কেঁদেছি, আমার জীবনে একটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। ২৬ বছরের বিবাহিত জীবনের পরও আমার কোন সন্তান নেই। গাউসূল আজমের সেই চাদর হাতে নিয়ে আল্লাহর কাছে আমি কেঁদেছি, একটি সন্তান চেয়েছি, আল্লাহ আমার কান্না শুনেছেন। আমাদের সন্তান হবে ইনশাল্লাহ।” এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সাল থেকে যে লড়াই সংগ্রাম হয়েছিল যে চেতনা নিয়ে এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেই সেই চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে ফরিদপুরের আটরশির পীর হযরত মওলানা শাহ সূফী হাশমতউল্লাহ সাহেবের কাছে চারজন জেনারেলকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে পীরের ছবক নিয়ে আসেন। বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার ব্যাপারে পীর সাহেব পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে এরশাদ ও তার দোসর ড. মজিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম উদ্বোধন করতে গেলে ছাত্ররা তা বর্জন করে। বর্জন প্রতিবাদের মুখে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব বাতিল করে দেয়া হয়। তার পেটুয়া বাহিনী পুলিশকে দিয়ে অবিরত চলতে থাকে ছাত্রনেতাদের গ্রেফতার অভিযান। ছাত্রলীগ (মু-হা) সাহিত্য সম্পাদক মোহন রায়হান, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও ইকসুর সহ-সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুক (পরে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রিয় সভাপতি) এবং ছাত্রলীগ (মু-হা) কেন্দ্রীয় নেতা আতাউল করিম ফারুক ও খন্দকার আব্দুর রহীমকে গ্রেফতার করে।
এরশাদ সরকারের চলমান কার্যক্রমে তৎকালীন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি সাইফুল আলম খান মিলন ও সাধারণ সম্পাদক তাসনীম আলম এক যৌথ বিবৃতিতে ঘোষিত শিক্ষানীতিকে ‘আদর্শহীন’ উল্লেখ করে শিক্ষানীতির আদর্শ হিসেবে দেশের শতকরা ৮৫ জন মানুষের আদর্শ ইসলামকে গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানায়।
১১ জানুয়ারী সচিবালয়ে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচী রদবদল করাকে কেন্দ্র করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে অসন্তোষ তৈরী হয়। প্রতিবাদে ছাত্ররা ডাকসু অফিস ভাংচুর করে। তবু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ শান্তিপূর্ণ পথেই দাবি আদায়ের সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার পথে অবিচল থাকেন। ১৪ ফেব্রুয়ারী বিক্ষোভ কর্মসূচীর ঘোষণা দেন।
৬ ফেব্রুয়ারী ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ বিরোধী আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়া হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর বিরোধিতা করলে সংঘর্ষ হয়, আহত হয় অর্ধশত ছাত্র। এই ঘটনার খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। কিন্তু ইসলামী ছাত্র শিবিরের এই স্বাধীনতা বিরোধী বক্তব্যে এরশাদ সরকার কোন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি।
এদিকে ছাত্রদের অবস্থান দেখে এরশাদ কিছুটা বিচলিত হয়, ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির ব্যাপারে একটি জনমত যাচাই কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পূর্বঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ১৪ ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী মিছিলসহ স্মারকলিপি পেশ করতে সচিবালয়ের দিকে যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও এই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং আন্দোলনে অংশ নেয়। এই মিছিলটি যখন হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছে তখন মিছিলের ওপর স্বৈরাচারি পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। আগে থেকেই বিপুল সংখ্যক দাঙ্গা পুলিশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে ঘিরে রাখে ও নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশ লাঠি, টিয়ারগ্যাস, জল কামান ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হয়নি, গুলিও চালায়। গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়। এক সময় ছাত্ররা আশ্রয় নেয় শিশু একাডেমীতে। সেখানে তখন শিশুদের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল। পুলিশ সেখানেও ঢুকে যায় অস্ত্র হাতে। কোমলমতি শিশুরাও সেদিন রক্ষা পায়নি এরশাদের বাহিনীর হাত থেকে। সারাদিনই এই অসম সংঘর্ষে জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চন প্রমুখ নিহত হন। দশ জনের মৃত্যু খবর পাওয়া যায় কিন্তু সরকারী প্রেসনোটে দাবী করা হয় মাত্র ১ জনের মৃত্যু হয়। আর আহত ও গ্রেফতার হয় অগণিত ছাত্ররা। এই ঘটনার পর ছাত্র আন্দোলনের বিষ্পোড়নের ভয়ে সরকার আবারো ঢাকা বিশ্¦বিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে ও ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করে।
এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে আসেন। সংঘর্ষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মিরপুর, আমতলী, তেজগাঁ, বাহাদুরশাহ পার্ক, ইংলিশ রোড, মতিঝিল এবং দেশের অন্যান্য জায়গাও এই আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনেও পুলিশ গুলি চালায় এবং চট্টগ্রামে মোজাম্মেল নামে একজন নিহত হন। ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে এরশাদ সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রামের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২৭ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে, পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বাণে সারাদেশে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
আর এই সংবাদ যাতে সারাদেশে ছড়াতে না পারে সেজন্য সংবাদপত্রগুলোতে আরো কড়াকাড়িভাবে সেন্সরশীপ আরোপ করা হয়।
১৪-১৭ ফেব্রুয়ারী এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সারাদেশে প্রচুর গ্রেফতার অভিযান চলে। বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের শীর্ষস্থানীয় প্রচুর ছাত্রনেতান ও বর্তমান সরকারের গ্রেফতার করে এরশাদ বাহিনী। তবু আন্দোলনকে দমাতে পারে নি।
ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে ১৭ ফেব্রুয়ারী তারিখে এরশাদ বলতে বাধ্য হয় যে- “জনগণের রায় ছাড়া শিক্ষা সম্পর্কে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।” এক সরকারী প্রেসনোটে বলা হয় যে, আন্দোলনে গ্রেফতারকৃত ১২২১ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
সেবছর সারাদেশে আক্ষরিক অর্থেই শোকাবহ একুশে ফেব্রুয়ারী পালিত হয়। বাংলা ভাষা ও শিক্ষার দাবীতে সারাদেশে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। কিন্তু রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারী পালন করতে পারেনি।
মজিদ খান প্রস্তাবিত স্বৈরশাসক এরশাদের বিতর্কিত শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সামরিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, লাঠি গুলি, টিয়ারগ্যাসকে পারোয়া না করে, গ্রেফতার নির্যাতন হুমকি হত্যার তোয়াক্কা না করে সেই মানুষজন রাস্তায় নেমেছিলো ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী তারিখে সেখান থেকেই মূলত এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী তারিখেই এদেশে সামরিক শাসনের ভীত কাঁপিয়ে দেয় সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্ররা। ধীরে ধীরে যা সার্বিক গণআন্দোলনে রূপ লাভ করে এবং সবশেষে ১৯৯০ সালের স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটে। ইতিহাসের পরিক্রমায় স্বাধীনতার পরে ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারীর এই ছাত্র আন্দোলনটিই বাংলাদেশের প্রথম গণ আন্দোলন যা বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত থামেনি।
এই সাফল্যমন্ডিত ছাত্র আন্দোলনটিকে মানুষের মন থেকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য ২৬৯ খ্রি. রোমান ভ্যালেন্টাইন দিবসের ইতিহাসকে বিকৃত করে বিশ্ব ভালবাসা দিবসে পরিণত করে বিশেষ করে ছাত্র, তরুণ সমাজ ও মানুষের মনোজগতকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে ফেলেছে শাসকগোষ্ঠিরা যা খুবই পরিকল্পিত উপায়ে। ধিক্কার, বর্তমান সময়ের শাসকগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোকে যারা এখন আর এই আন্দোলনকে পালন না করে বরং মদদ দিচ্ছে, কেননা ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার (কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন) এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এতগুলো মানুষকে হত্যার পরেও তার সঠিক বিচার না হয়ে বহাল তবিয়তে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্টিত রয়েছে তার দল। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্টিতরা বাংলা বর্ষপুঞ্জি পরিবর্তন করে ১লা ফাল্গুন পালন করে এবং লাল গোলাপ হাতে বিপ্লব ভুলে ভালোবাসার জয়গানে দেশবাসীকে মাতোয়ারা হতে আহ্বাণ জানায়। দেশে ঢুকে যায় অভিনব পন্থায় স্বৈরাচারী বিষয়। আর আমরা জাফর-জয়নাল-দীপালীসাহাদের ভুলে বসন্ত আর ভালবাসা দিবস পালনে মেতে উঠি। এভাবেই আন্দোলন ভুলে আমরা মিছে ভালোবাসার বেসাতিতে পা দিয়েছি।
লেখকঃ ওবায়দুর রহমান
০১৭৫১৯২৯৩৫৩
লেখক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
গৌরীপুর শাখা সংসদ
ইমেইলঃ news.gouripurnews@gmail.com