ময়মনসিংহশুক্রবার , ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ভাতা নয়, স্বীকৃতি চান রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ

স্টাফ রিপোর্টার
ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯ ৬:১২ অপরাহ্ণ
Link Copied!

কাঠমিস্ত্রি আব্দুর রশিদ। মাতৃভূমি রক্ষায় জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার পর রণাঙ্গণের সহযোদ্ধা শহীদ আবু খার মা টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ায় অভিমান করেই স্বীকৃতি চাননি আব্দুর রশিদ। কিন্তু জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসে ভাতা নয় ,মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান এই রণাঙ্গণের যোদ্ধা।

আব্দুর রশিদের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের বাঘবেড় গ্রামে। তার বাবা-মৃত হাফিজ উদ্দিন। মাতা মৃত- শহরের নেছা। পেশায় কাঠমিস্ত্রি হলেও গ্রামবাসী তাকে একজন বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হিসাবে চেনে। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়লেও এখনো প্রতিবছর ১৫ আগস্ট একা একা টুঙ্গিপাড়া যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করতে।

বৃহস্পতিবার সকালে বাঘবেড় গ্রামে গিয়ে কথা হয় আব্দুর রশিদের সাথে।

আলাপচারিতায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে রণাঙ্গণের নানা ঘটনা তুলে ধরেন এই প্রতিবেদকের কাছে। আব্দুর রশিদ বলেন ‘১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহ শহরে আনসারের (সশস্ত্র) প্রশিক্ষণ নেই। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেয়ার পর আনসার শিবিরে গুঞ্জন শুরু হয় যেকোনো মুহূর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধেও ডাক আসতে পারে তাই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
১৯৭১ সারের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী নির্বিচার গণহত্যা শুরু করলে পরের দিন আমাদের গ্রামে খবর পৌছে। এরপর আমরা আনসাররা ময়মনসিংহে জড়ো হই।
পাকবাহিনী ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ না আসতে পারে সেজন্য জেলা আনসার অফিসার মালেক সাহেব আমাদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে প্রত্যেককে অস্ত্র ও গুলি দিয়ে কেওয়াটকালী এলাকায় রেলপথে পাহাড়ায় পাঠান। কয়েকদিন পর সেখান থেকে আমার ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে যাওয়ার পথে পাকবাহিনী বিমান হামলা করলে ছত্রভঙ্গ হয়ে অস্ত্র নিয়ে গৌরীপুর বাড়িতে আসি। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রশিক্ষণ নিতে উচাখিলা এলাকার এক সেনা সদস্যর সাথে অস্ত্র নিয়ে নেত্রকোনার রংরা বর্ডার দিয়ে ভারত প্রবেশ করি’।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কোম্পানী কমা-ার নাজমুল হক তারার নেতৃত্বে নেত্রকোনার কলমাকান্দা, নাজিরপুর, বাইশদার, বড়াইল, নেত্রকোনা বিজয় সহ বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন আব্দুর রশিদ।
ভারত প্রবেশের পর ইয়ুথ ক্যাম্পে ইন্ডিয়ান আর্মি ক্যাপ্টেন চৌহানের দেখা হলে রশিদ সেখানে থেকে যান। পরের দিন নাজমুল হক তারার কোম্পানি তুরা ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে আসার খব পেয়ে ক্যাপ্টেন চৌহানের অনুমতি তাদের দলে ঢুকে পড়েন রশিদ। এরপর বাংলাদেশে প্রবেশ করে নেত্রকোনারা ঠাকুরাকোনা ব্রিজ ধ্বংস করেন।


নেত্রকোনার নাজিরপুর যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আব্দুর রশিদ বলেন, নাজিরপুর বাজারে একটি কাচারীতে পাঞ্জাবিদের ক্যাম্প ছিলো। আমাদের কোম্পানী কমান্ডার তারা ভাই পরিকল্পনায় ওই ক্যাম্প আগুন দিয়ে পুড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়। এসময় কংশ নদীর হয়ে পাঞ্জাবিরা অতর্কিতে আক্রমণ করলে ডা. আজিজ, ফজলুল হক, ইয়ার মাহমুদ সহ সাতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে কমান্ডার তারা ভাই মারাত্বক ভাবে আহত হন।

নেত্রকোনা শহর বিজয় করতে ১৯৭১ সালের ৮ ই ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান আর্মি ক্যাপ্টেন চৌহান ও তারা কোম্পানির আবু সিদ্দিক ও খসরু ভাইয়ের নেতৃত্বে ভোররাতে পাকবাহিনীকে লক্ষ করে মর্টার শেল নিক্ষেপ করলে মোক্তার পাড়া ব্রীজ সংলগ্ন এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। আমি আর আবু খা ব্রিজের দক্ষিণ পাড় থেকে পাকবাহিনীকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ছিলাম। এসময় পাকবাহিনীর একটি বুলেট আবু খা বুকে আঘাত হানলে সে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এছাড়াও ওই যুদ্ধে আব্দুর রশিদ ও আব্দুস সাত্তার শহীদ হন। গুরুতর আহত সিদ্দিক ভাই।

কথা প্রসঙ্গে রশিদ জানান, স্বাধীনতার পর শহীদ আবু খার বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি টাকার অভাবে তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা হচ্ছেনা। এরপর আমি বাড়ি এসে কিছু টাকা সংগ্রহ করে কয়েকদিন পর ওই বাড়িতে গিয়ে আবু খার বোনের হাতে টাকা দিয়ে বলি মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। তখন তার বোন কাঁদতে কাঁদতে কবর দেখিয়ে বলেন মা আর বেঁচে নেই। স্বাধীন দেশে শহীদের মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো সেই কষ্টে স্বীকৃতি চাইনি। এখন বয়স হয়ে গেছে। তাই মৃত্যুর আগে সকারের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নিজের নামের স্বীকৃতিটা দেখে যেতে চাই। আমার কোনো ভাতার দরকার নেই।

নেত্রকোনা সদর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আইয়ুব আলী বলেন, আমাদের কোম্পানি যখন ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে আসছিরো তখন ভারতীয় আর্মি ক্যাপ্টেন চৌহান অস্ত্রসহ রশিদ ভাইকে আমাদের দলে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর রশিদ ভাই আমাদের সাথে থেকে নেত্রকোনা অঞ্চলের সবগুলো যুদ্ধে বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই রশিদ ভাই একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তাকে যেনো দ্রুত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করে রাষ্ট্রীয় সকল সম্মাণ ও সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়।

    ইমেইলঃ news.gouripurnews@gmail.com