ময়মনসিংহশুক্রবার , ১ জুলাই ২০২২
আজকের সর্বশেষ সবখবর

হয়ে ওঠেনি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, হারিয়েছে সংগ্রামী ঐতিহ্য

ড. কাবেরী গায়েন 
জুলাই ১, ২০২২ ১১:১৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

শুরুটা ছিল স্বাধীনচিন্তা আর মুক্তবুদ্ধির
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল উজ্জ্বলভাবে। শুরুতেই ‘নাথান কমিটি’র সুপারিশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলার প্রস্তাবের বিপরীতে জিতেছিল ‘স্যাডলার কমিটি’র সুপারিশ আর তা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে স্বায়ত্তশাসিত।

তাই শুরুতেই, স্বায়ত্তশাসিত মুক্তবুদ্ধি চর্চার অবারিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্বমানের পণ্ডিতদের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র হিসেবে। একদিকে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তিব্বত ও নেপাল থেকে উদ্ধার করেন চর্যাপদ ও দোহাসহ প্রাচীন বৌদ্ধসাহিত্য। চর্যাপদকে তিনি পরিচিত করান বাংলাভাষার আদিরূপ হিসেবে।

একই বিভাগের এস. কে. পাল গবেষণা করেছেন বৈষ্ণববাদ নিয়ে, আর ভাষাতত্ত্ব নিয়ে বিশ্বমানের কাজ করেছেন বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। অন্যদিকে বিজ্ঞান অনুষদও গড়ে উঠেছিল বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত আর গবেষকদের দিয়ে। এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন অধ্যাপক অজয় রায় (২০১৩)। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নির্দেশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ঘোষ ল’-খ্যাত রসায়নবিদ স্যার জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ এসেছিলেন রসায়ন বিজ্ঞানের প্রধান হিসেবে।

পদার্থ বিজ্ঞানের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক ওয়াল্টার জেমস জেনকিন্স, যিনি কুলিজ টিউব থেকে ইলেকট্রন বিমের চরিত্র নিয়ে কাজ করেছেন। ছিলেন রিডার বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী সত্যেন বোস। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বসেই তিনি উদ্ভাবন করেন কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিক্স যা এখন বোস স্ট্যাটিসটিক্স নামে পরিচিত।

জড় কণিকার ওপর প্রয়োগ করে আইনস্টাইনের পরিধি বাড়ান আর এই পরিসংখ্যান পরিচিতি পায় বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস নামে। যেসব প্রাথমিক কণিকা এই সংখ্যায়ন মেনে চলে তাদের বলা হয় বোসন। কাজ করেছেন পদ্মভূষণ আচার্য শ্রীনিবাস কৃষ্ণাণ (কে এস কৃষ্ণাণ নামেই বেশি পরিচিত)। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল ক্রিস্টাল ম্যাগনেটিজমের উপর তার পাঁচটি ক্ল্যাসিক প্রবন্ধ যা বিশ্ববিখ্যাত।

শুরুটা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের এতটাই উজ্জ্বল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর বেড়েছে আর যুক্ত হয়েছে নতুন প্রতিভার সম্ভার। যুক্ত হয়েছেন মোহিতলাল মজুমদার, উদ্ভিদবিজ্ঞানী জিপি মজুমদার, ইতিহাস বিভাগ থেকে ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার সম্পাদনা করেছেন The Early History of Bengal (১৯২৪), আর দ্বিতীয় খণ্ড বের হয়েছে স্যার যদুনাথ সরকারের সম্পাদনায় A History of Bengal।

অধ্যাপক অজয় রায় (২০১৩) এবং অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম (২০০১)-এর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, তখন গড়ে উঠেছে ‘শিখা গোষ্ঠী’ আর ‘প্রগতি লেখক সংঘ’। মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসাইন, আবদুর রহমান খাঁ-র মতো তখনকার তরুণ শিক্ষকেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের, যা মুসলিম সমাজের রেনেসাঁ হিসেবে খ্যাত।

আচার্য সত্যেন বোসকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল আড্ডার আসর ‘বারোজনা’। এই ‘বারোজনা’-য় ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ড. জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, আইন বিভাগের নরেশ চন্দ্র মিত্র, ইতিহাসের অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো ব্যক্তিরা। ‘বারোজনা’ যেসব সেমিনারের আয়োজন করতো, সেখানে বক্তৃতা করেছেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন, কে এস কৃষ্ণাণ। বের হয়েছে বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের সম্পাদনায় পত্রিকা ‘বিজ্ঞান পরিচয়’।

দেশভাগ হয়েছে ১৯৪৭ সালে কিন্তু বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলন তথা মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্র থামেনি। এসেছেন নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, লিখেছেন ‘কবর’। এই বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম দিয়েছে এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের—অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী; রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান—যারা দিয়েছেন অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্ব’ পাকিস্তান আমলে। উচ্চশিক্ষায় কান্ডারি হয়ে দাঁড়িয়েছেন খান সরোয়ার মুর্শিদ, ড. আহমেদ শরীফ, অধ্যাপক অজয় রায়, বিজ্ঞানী কুদরত-ই-খুদা প্রমুখ।

পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির নতুন কাব্যভাষা তৈরি করেছেন যে শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান তারাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন একসময়।

আবার প্রবল পাকিস্তানি সিনে-ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে প্রায় একাই লড়েছেন যে জহির রায়হান কিংবা ‘লিবারেশন টাইগার্স’ বানালেন যে আলমগীর কবির একাত্তরের বদ্ধ দিনগুলোতে, ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন যে ভাষা মতিন কিংবা স্বাধীনতার স্বপ্ন বিকশিত হয়ে পরিণতি পেল যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, সেই পরম নেতা এবং তার সহযোগী ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বাঙালির আরেক মহান নেতা তাজউদ্দীন আহমদ সকলেই এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়েছেন দর্শনে অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব। বাংলা সাহিত্যে অধ্যাপক অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আনোয়ার পাশা। ইংরেজি সাহিত্যে ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, হুমায়ূন কবির, রাশিদুল হাসান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই কাজ করেছেন সমাজবিজ্ঞানের দুই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক নাজমুল করিম, অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন। ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য।

এই বিশ্ববিদ্যালয় ধারণ করেছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে। ধারণ করেছে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম, ড. মমতাজুর রহমান তরফদার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম কিংবা ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ-এর মতো শিক্ষকদের। বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, আইন, ব্যবসা-প্রশাসনসহ সকল শাস্ত্রে এখন পর্যন্ত যারা মেধাবী এবং জাতিকে নির্দেশনা দিয়েছেন, দিয়ে চলেছেন—তাদের সিংহভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবিতার সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হয়েছিল বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে। তবে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ কালপর্বে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মোকাবিলাও করতে হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কেই। ফলে বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সেই আন্দোলনের লক্ষ্যাভিসারী জ্ঞানের চর্চা একটু একটু স্থান করে নিয়েছে। ফলে বিশুদ্ধ গবেষণা, যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য, সেই অবস্থান কমপ্রোমাইজড হতে শুরু হয় এই কালপর্বেই।

বিজ্ঞান গবেষণার চেয়ে ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় বিষয়ের গবেষণা বা পর্যবেক্ষণ অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পায়, যা একটি যুদ্ধমান জাতির জন্য হয়তো স্বাভাবিক। আর পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের যুদ্ধ যে কেবল ১৯৭১-এ হয়েছে, এমন নয় বরং যুদ্ধ এই গোটা কালপর্বেই ছিল।
সর্বোপরি, দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের ১৯৭১ সালে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী এদেশের আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর সাহায্যে। ফলে স্বাধীনতার পর পরই একটি সার্বিক মেধাশূন্যতার কবলে পড়ে যায় এই দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই গবেষণা এবং শিক্ষার সার্বিকখাতে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ বরাদ্দের বৈষম্যও ছিল প্রকট।

স্বাধীনতার পরে, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ, যে অধ্যাদেশে শিক্ষকদের নৈতিকতা ও বিবেককে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয় যেকোনো কাজ চালানোর ব্যাপারে, সেই অধ্যাদেশের সুযোগের সম্ভবত সর্বোচ্চ অপপ্রয়োগও হয়েছে। দু’টি কারণে এটি হয়ে থাকতে পারে। প্রথমত, প্রবল দলীয় রাজনীতি এবং দ্বিতীয়ত, নৈতিক দায় সম্পর্কে দায়বদ্ধতা না থাকা।

বিশেষ করে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরবর্তী বাস্তবতা যা মূলত সেনাশাসন ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি—এই দুই ধারায় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিভক্ত করে ফেলে। শিক্ষক রাজনীতি প্রবল হয়ে ওঠে দলভিত্তিক রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানি সেনা-শাসনকে হটিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম, সেই বাংলাদেশে দীর্ঘকাল কার্যত সেনাবাহিনীর নামে-বেনামে শাসনকালে শিক্ষক-রাজনীতি ও ছাত্র-রাজনীতিকে কলুষিত করার একটি চক্রান্ত শুরু থেকেই জারি ছিল। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো সেই দুর্গ, যাকে যেকোনো স্বৈরশাসক ভয় পেয়েছেন।

এই চক্রে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার ব্যাপার যেমন প্রাধান্য পায় শিক্ষক রাজনীতির একাংশে, অন্যদিকে স্বার্থান্বেষী রাজনীতিও গ্রাস করতে থাকে শিক্ষক সমাজের আরেক অংশকে। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে যা হওয়া স্বাভাবিক, সেটিই হয়েছে। প্রবল রাজনীতিকীকরণের কবলে পড়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্রের শাসকেরাও তাই চেয়েছেন।

স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ধারণা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছিল সেই ১৯২১ সালে, ‘স্যাডলার কমিশন’- এর প্রস্তাব জয়যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে, সেখানে ফাটল ধরে। ক্রমশ সরকারি হয়ে উঠতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়। সরকার পতনের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রশাসনের সকল পদে আমূল পরিবর্তন ঘটে।

এমনকি রাতের অন্ধকারে উপাচার্যের অফিস দখলের মতো ঘটনাও ঘটেছে। কাজেই, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ প্রকট হয়ে উঠেছে। মেধার সাথে সমঝোতা এই নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন প্রায় ‘প্রাকৃতিক’ হয়ে উঠেছে। তার অর্থ আবার এও নয় যে, মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিয়োগ পান না, তারাও পান, তবে এই রাজনৈতিক স্ক্রুটিনি পার করে। এই প্রথম দফা কম্প্রোমাইজ মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলেছে শিক্ষকদের স্বাধীন চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রে।

বলে নেওয়া দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা কেবল শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নয়, বরং নতুন জ্ঞানের উৎপাদনের সাথেও সম্পর্কিত, যা নিশ্চিত করে নিত্য-নতুন গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাঙ্কিং-এ বাংলাদেশ ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে, এমনকি এশিয়ার শীর্ষ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও আর বাংলাদেশের অবস্থান নেই।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিং ২০২৩ প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। সংস্থাটি যে এক হাজার ৪০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে এবারও প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থান হয়নি।

২০২১ সালের মতো এই বছরের তালিকাতেও দেশের শীর্ষ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০১ থেকে ১০০০ এর মধ্যে রয়েছে। এই রেটিং হয় একাডেমিক খ্যাতি, চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষক প্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাতের ভিত্তিতে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষক প্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাতের হিসেবে এসে আমাদের হোঁচট ক্রমাগত দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে—২০১২ সালে কিউএস’র তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০১ এর মধ্যে। ২০১৪ সালে তা পিছিয়ে ৭০১তম অবস্থানের পরে চলে যায়। ২০১৯ সালে তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আরও পেছনের দিকে চলে যায়।

ইতিমধ্যে আরও দু’টি বিপর্যয় ঘটে গেছে বৈশ্বিকভাবে। প্রথমটি নতুন উদারনৈতিক অর্থনীতি এবং এনজিও কার্যক্রম। নতুন উদারনৈতিক অর্থনীতি একদিকে সারা পৃথিবীর মানুষকে ভোগবাদী একটি সমাজের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

বহুজাতিক করপোরেশন কৃত্রিম চাহিদা তৈরি আর পুনরুৎপাদন করে প্রচার করে চলেছে গণমাধ্যমে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের সাবসিডি কমিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ক্রমাগত সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে।
অন্যান্য পেশার মানুষের সাথে সাম্যমূলক জীবন চালানোর জন্য যে অর্থনৈতিক সামর্থ্য থাকা চাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একজন শিক্ষকের জন্য তার খুব সামান্য অংশই দিতে পারছে। ফলে একজন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই বাড়তি রোজগারের চিন্তা করতে হচ্ছে। তিনি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যাচ্ছেন। বাড়িভাড়ায় একটু সাশ্রয়ের জন্য আবাসিক শিক্ষক হতে চাইছেন কোনো হলের। আবাসিক শিক্ষকতা যে ধারণা থেকে প্রনয়ণ করা হয়েছিল, তার সাথে আজ আর কোনো সম্পর্ক নেই।

সত্যি কথা বলতে একটি স্বল্পমূল্যে আবাসন পাওয়াই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি দাক্ষিণ্য হিসেবেই দেখে এবং বিনিময়ে দলীয় অনুগত্য আশা করে। শুধু ভদ্রস্থ একটি জীবন-যাপনের জন্যই যখন রাজনীতির নামে দলীয় আনুগত্য এবং বাড়তি আয়ের জন্য নানা জায়গায় ছোটাছুটি করতে হয়, তখন শিক্ষায়তনিক বিষয়ে পর্যাপ্ত মনোযোগী হওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা তো আরও দূরের কথা।

এবার আসা যাক, গবেষণায় বরাদ্দ প্রসঙ্গে। গবেষণা করতে টাকা লাগে। বিগত বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা-গবেষণা খাতে আর্থিক বরাদ্দের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে গবেষণা খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল শুধু নয়, প্রতিবছর এই বরাদ্দ কমছে।

শিক্ষা-গবেষণাখাতে ক্রমহ্রাসমান বরাদ্দ একদিকে, অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা মোট বাজেটের ৮০ শতাংশের উপরে ব্যয় হয়, গবেষণাখাতে ১%-এর বেশি হয় না। এবছরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৯২২.৮ কোটির বাজেটের ১.৬৩% মাত্র বরাদ্দ করা হয়েছে গবেষণা খাতে।

এই অবস্থার মধ্যেও যখন প্রমোশনের জন্য নির্দিষ্ট ছক পূরণ করতে হয় একজন শিক্ষককে, তখন প্রকাশনা দেখাতে হয়। অনুষদ জার্নালগুলোতে যেসব লেখা প্রকাশিত হয়, সেসব প্রকাশনায় প্রকৃত জ্ঞানের উৎপাদনের চেয়ে পদোন্নতির দিকেই মনোযোগ রাখা হয়। ফলে একটি গভীর সংকটে পড়েছে আমাদের প্রকাশনা-মান, যা আন্তর্জাতিক পরিসরে পৌঁছাতে পারছে না। সৃজনশীলতা ব্যাহত হচ্ছে।

উপরন্তু, ক্রমাগত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ক্রমাগত সরকার কর্তৃক মনোনীত হওয়ার কারণে সরকারি হস্তক্ষেপের বিপরীতে শক্ত অবস্থান নিতে সক্ষম হচ্ছে না। অন্যদিকে, আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বুদ্ধিবৃত্তির অনেকটাই নিয়োজিত থেকেছে বিভিন্ন এনজিও-গবেষণার প্রস্তাবনা লেখা এবং অনেক ক্ষেত্রেই ফরমায়েশি গবেষণা সম্পন্ন করার মধ্যে। সেও তো অর্থনৈতিক কারণে।

তবে এইসব গবেষণায় ক্ষতি ছিল না, যদি বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো এসব উপার্জনের অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ফান্ডে জমা হতো, যা দিয়ে সেই শিক্ষকেরাই গবেষণা সহকারী রাখতে পারতেন। কারণ, টাকা আনতে না পারলে গবেষণা সহকারী কীভাবে রাখবেন? গবেষণা সহকারী ব্যতিরেকে গবেষণা করবেন কীভাবে? গবেষণা করতে না পারলে প্রকাশনা হবে কীভাবে? প্রকাশনা না হলে প্রমোশন কীভাবে হবে? কিন্তু আমরা এই স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যে যাইনি। তবে কেবল শিক্ষকদের দোষ না দিয়ে বরং যে পদ্ধতি তৈরি হয়েছে, সেই পদ্ধতিকে প্রশ্ন করা জরুরি।

রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়
একটা সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সংগ্রামী ঐতিহ্য জনমানসে আস্থা তৈরি করেছিল, সেই পরিস্থিতি ক্রমশ ফিকে হতে হতে একেবারে ঘুচে গেছে বলা যায়। বিশেষ করে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পরে একমাত্র সুষ্ঠু ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালে। এরপরে আর কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি।

দীর্ঘ ২৮ বছর পরে যে বিতর্কিত ডাকসু নির্বাচন হয় ২০১৯ সালে, সেই ডাকসুর কোনো কার্যক্রম নেই। টিএসসিতে এখন আর নিয়মিত নাটক বা গানের মহড়া দেখা যায় না। আশেপাশের দেশের সাথে সাংস্কৃতিক চুক্তি ও বিনিময়েও ঘাটতি রয়েছে।

বিদেশি শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের আনাগোনা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে আগে ডাকসু এবং হল সংসদের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যারা উঠে আসতেন তারাই হতেন নেতা। সেই প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার শর্তটির গোঁড়া কেটে গেছে।

যে কারণে এক কোটা সংস্কার বিরোধী আন্দোলন ছাড়া শিক্ষার্থীদের আর পাওয়া যায় লাইব্রেরিতে, বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে। শিক্ষকদের রাজনীতিও যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই রাজনৈতিক দলের সমর্থনকারীদের কুক্ষিগত হতে হতে শিক্ষক সমিতিও শিক্ষকদের বেতন-ভাতার বাইরে গবেষণা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে বিচলিত নয়।

একচেটিয়া নিবিড় সরকারি দলের অনুগত শিক্ষকদের মেরুদণ্ড বাধা পড়েছে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার দর কষাকষিতে। যারা এই বৃত্তের বাইরে, তারা নানাভাবে কোণঠাসা। ফলে শ্যামলকান্তি ভক্ত-হৃদয় মণ্ডল-আমোদিনী পাল-স্বপন কুমার বিশ্বাস-উৎপল সরকারের ঘটনাতেও বিচলন দেখা যায় না শিক্ষক সমাজের মধ্যে। বাকস্বাধীনতার চর্চা অত্যন্ত সীমিত। ফলে শিক্ষা গবেষণার মান যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের তেজ।

সামগ্রিক উত্তরণ কোন পথে
আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ সারা পৃথিবীতেই সবচেয়ে কম দেশগুলোর মধ্যে পড়ে। জাতীয় আয়ের ২.২ শতাংশ মাত্র ছিল ২০২১ সাল পর্যন্ত, এই বছর ১.৮৩ শতাংশ। শিক্ষকদের জীবন-ধারণের মতো পর্যাপ্ত বেতন দিতে হবে, যেন তিনি কেবল জীবন-যাপনের জন্য চিন্তিত না থেকে শিক্ষা ও গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন।

দীর্ঘদিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন ব্যবস্থার দাবি শুনে আসছি, ফলাফল হলো বেতন বৈষম্য আরও বেড়েছে সর্বশেষ বেতন কাঠামো বিন্যাসে। গবেষণা খাতে বাজেট চালু করতে হবে। শিক্ষক সমিতি তো শিক্ষকদের এমন সব দাবি আদায়ের জন্যই কাজ করবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা থাকে।

সমস্যা হচ্ছে, শিক্ষক সমিতির শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করার কথা থাকলেও, সরকার পরিবর্তনের সাথে শিক্ষক সমিতিরও পরিবর্তন হতে দেখা যায় ফলে দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে যে আন্দোলন দৃশ্যমান হওয়ার কথা, সেটি হয় না।

অর্থের জোগানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিবেচনা দরকার এই কারণে যেকোনো রাষ্ট্র তার মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য যত ধরনের বিনিয়োগ করতে পারে, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ হলো শিক্ষায় বিনিয়োগ। শিক্ষকেরা এই মর্মে বরং আলোচনা নিয়ে আসতে পারেন রাষ্ট্রীয় ও জনপরিসরে।
অর্থের বরাদ্দ বাড়লে, শিক্ষা-গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে গবেষণার উপর ও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা জার্নালে প্রকাশের মতো গবেষণার উপর জোরারোপ করতে হবে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই  RAE (Research Assessment Exercise)-এর ব্যবস্থা করতে পারেন।
প্রত্যেক চার বছর সময়ের মধ্যে তার শ্রেষ্ঠ চারটি প্রকাশনা জমা দেবেন যার ওপরে মূল্যায়ন হবে। এই একটি কাজ বাধ্যতামূলক করা গেলে সকল বিভাগ চাপের মধ্যে থাকবে। তখন আসবে শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্ন।

এখন যেমনভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে, তারচেয়ে বিভাগে কোন বিষয়ে শিক্ষক প্রয়োজন, সেটি ধরে সেই ক্ষেত্রে যাদের কাজ আছে তাদের নিয়োগ যদি করা যায়, তাহলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

এখন যেভাবে নিয়োগ করা হয় কেবল রেজাল্ট দেখে, তাতে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর পড়ানোর দক্ষতা সম্পন্ন শিক্ষকের চেয়ে সবাই সব জানেন ধরনের মধ্যম মানের শিক্ষাই কেবল নিশ্চিত করা যায়। কেবল শিক্ষাদান যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য, যাদের বলা হয় ‘টিচিং ইউনিভার্সিটি’, সেসব ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কার্যকর হলেও ‘রিসার্চ ইউনিভার্সিটি’র জন্য বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শীদের আনার ব্যাপারে আন্তরিক হতেই হবে। নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরতে পরতে লেখা আছে সৃজনশীল মানুষের কাজ আর সংগ্রামের ইতিহাস। আছে ২৯ হাজার শিক্ষার্থী, ১০টি অনুষদ, ১৫টি ইন্সটিটিউট, তিন হাজারের উপর শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে আছে হাজার হাজার বই। কাজ করেছেন বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিতেরা।
কাজ করছেন মেধাবী শিক্ষকেরা, যারা নিজেদের উদ্যোগে সকল প্রতিকূলতার বিপরীতে আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখা ছাপাচ্ছেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রশংসিত হচ্ছেন, সংখ্যায় কম হলেও বিশ্বের নামি প্রকাশনা থেকে বই বের করছেন। নানা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটে গবেষণার জায়গা কাঙ্ক্ষিতমাত্রায় পৌঁছায়নি একথা মানলেও, সম্ভাবনা রয়েছেই কারণ আমাদের গাঁথুনি খুব মজবুত। সেখানে স্থানে স্থানে অবহেলা জমা হয়েছে মানি, কিন্তু সেই অবহেলা সরিয়ে ফেলতে পারলেই একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

একশ বছর পূর্তির পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তার যাত্রা শুরু করবে, সেটিই প্রত্যাশা। প্রত্যাশা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে পাবে তার সংগ্রামী ঐতিহ্য।

ড. কাবেরী গায়েন 

অধ্যাপক,

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

    ইমেইলঃ news.gouripurnews@gmail.com