১৯৭১ সনের ৩০ নভেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ময়মনসিংহের গৌরীপুুর ও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম পলাশকান্দায় শহীদ হন চার মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, আনোয়ারুল ইসলাম মনজু ও মতিউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এ ঐতিহাসিক স্থানটি অযতœ ও অবহেলায় বর্তমানে অরক্ষিত। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও সম্মুখ যুদ্ধের এ স্থানটি সরকারিভাবে সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে এ স্থানটিকে সংরক্ষণের জোরালো দাবি করেছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
পলাশকান্দা ট্র্যাজেডির স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমিন বলেন, ৭১’র এই দিনে গৌরীপুরসহ সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলায় পাক হানাদার বাহিনী যখন দিশেহারা। সে সময় মুজিব বাহিনীর একটি গেরিলা দল ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী পাক হানাদার বাহিনীর কনভয়ে হামলা করার জন্য গৌরীপুর ও ঈশ্বরগঞ্জের সীমান্তবর্তী গ্রাম পলাশকান্দা গ্রামে অবস্থান নেন। মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মোঃ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে (বর্তমানে মৃত) স্থানীয় মুজিব বাহিনীর সদস্যরা এতে অংশ নেন।
উল্লেখিত গ্রামে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খবর ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে অত্যন্ত সুকৌশলে পৌছে দেয় একই গ্রামের স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার মজিদ মাষ্টার । মুজিব বাহিনীর দলটি আক্রমন পরিকল্পনা শেষ করে যখন দুপুরের খাবার খেতে বসে ঠিক সেই মুহূর্তে পাক হানাদার, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সম্মিলিত একটি টিম মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের তিন দিকে ঘিরে ফেলে বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়তে থাকে। অপ্রস্তুত অবস্থায় অতর্কিত আক্রমনের শিকার মুক্তিযোদ্ধারা এসময় প্রতিরোধে গেলেও পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
এ সময় হানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারে মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। হানাদারের হাতে আহত অবস্থায় ধরা পড়েন আনোয়ারুল ইসলাম মনজু, মতিউর রহমান ও সিরাজুল ইসলাম। পরে এ তিন মুক্তিযোদ্ধাকে হানাদার ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের পর ব্রক্ষপুত্রের নদীর চরে তাদের চোখ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উপরে ফেলে হত্যা করা হয়। এ তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্মুখ যুদ্ধের পরদিন শহীদ জসিম উদ্দিনকে পলাশকান্দায় যুদ্ধের স্থান সংলগ্ন একটি জঙ্গলে সমাহিত করা হয়।
স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন শাহীন জানান, শহীদ জসিম উদ্দিনের বাড়ি নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার হাপানিয়া গ্রামে। তিনি গৌরীপুর উপজেলার কাউরাট গ্রামে স্থানীয় এক আত্মীয়ের বাড়িতে লজিং থেকে লেখাপড়া করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জসিম উদ্দিন গৌরীপুর রাজেন্দ্র কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
আর শহীদ সিরাজুল ইসলাম গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর গড়পাড়া গ্রামের মৃত মনফর উদ্দিন কেরানীর ছেলে ও শহীদ আনোয়ারুল ইসলাম মনজু গৌরীপুর পৌর শহরের মৃত আব্দুল মৌলার ছেলে। শহীদ মতিউর রহমান ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার খৈরাটি গ্রামের মৃত আব্দুস সালামের ছেলে। মতিউর রহমান গৌরীপুর পৌরসভার পশ্চিম ভালুকায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মৃত আজিজুল হক বাবুর বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন। শহীদ মনজু, সিরাজ ও মতি ৩ জনই গৌরীপুর সরকারি কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের পর শহীদ মনজুর পিতা আব্দুল মৌলার কাছে প্রেরিত এক পত্রে লিখেছিলেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য পুত্র আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবোদনা। আপনার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইলো আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশ প্রেমিকের পিতা হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের নিকট ২০০০ টাকার চেক প্রেরিত হল। আমার প্রাণঢালা ভালবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের এ সম্মুখ যুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ২০১২ সনে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৌমেন্দ্র কিশোর মজুমদার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.এ সাত্তারের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় পলাশকান্দায় ভারতী বাজারে চার শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি ছোট স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। পলাশকান্দায় সম্মুখ যুদ্ধের স্থান সংলগ্ন শহীদ জসিম উদ্দিনের কবরটি পাকা করে দেন গৌরীপুরের বিশিষ্ট চক্ষু চিৎিকসক মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ডাঃ একেএমএ মুকতাদির। স্বাধীনতার পর শহীদ মনজুর নামে গৌরীপুর পৌর শহরে একটি সড়কের নামকরন করা হয়েছে। গৌরীপুর আর.কে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ শহীদ জসিম উদ্দিনের নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পলাশকান্দায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন মনজুর প্রতিকী কবর ২০২১ সনে গৌরীপুর মুক্তিযোদ্ধা কবরাস্থানে স্থাপন করা হয় ও ঈশ্বরগঞ্জের খইরাটি গ্রামে শহীদ মতিউর রহমানের কবর পাকাকরন হয়েছে। পলাশকান্দায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত স্থানটিতে যাওয়ার জন্য একটি মাটির রাস্তা করা হয়েছে।
শহীদ আনোয়ার হোসেন মনজুর ভাই ম. নুুরুল ইসলাম জানান- প্রতি বছর ৩০ নভেম্বর গৌরীপুর ও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ, জনপ্রতিনিধি, শহীদ পরিবারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ স্থানীয় লোকজন পলাশকান্দায় যান শহীদ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে স্বাধীনতার ৫২ বছরে যুদ্ধের এ স্থানটিকে সংরক্ষণে সরকারিভাবে কোন উদ্যোগ নেই এটা দুঃখজনক।
ইমেইলঃ news.gouripurnews@gmail.com