ঢাকাশুক্রবার , ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
আজকের সর্বশেষ সবখবর

প্রয়াণদিবসে স্মরণ : বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গান ও তাঁর চিন্তাভাবনা: ইমতিয়াজ আহমেদ

ইমতিয়াজ আহমেদ
সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৪ ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

বাংলার মাটি বাউল সাধকদের পুন্যভূমি। যুগ যুগ ধরে বাংলার মাটিতে আগমন ঘটেছে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত বাউল সাধকদের। তাঁরা তাঁদের গানের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন সৃষ্টির কথা, সৃষ্টিতত্ত্বের কথা, মানবতার কথা, সহমর্মিতার কথা, সহনশীলতার কথা, সম্প্রীতির কথা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা। তেমনি একজন বাউল সাধক শাহ আব্দুল করিম। যিনি তাঁর গানের মাধ্যমে উপরোক্ত বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন সাবলীলভাবে।

তিনি তাঁর গানে বলেছেন:
“গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।”

সহজ সরল সাধারন কথা। অথচ প্রখর চিন্তাভাবনার প্রকাশরূপ। এই সাধারন শব্দে তিনি বাঙালীর সহজ সরল অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ ও সমাজবোধের কথা বলেছেন। বলেছেন দেশত্ববোধের কথা। বলেছেন মানুষে মানুষে সহমর্মিতা সহনশীলতা সম্প্রীতির কথা। কিন্তুু আজ আমরা এসব শুভ বোধ থেকে যেন যোজন যোজন দূরে চলে এসেছি। যার জন্য সমাজে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। মানুষে মানুষে হিংস্রতা ও দ্বন্দ্ব। এই নেতিবাচক চিত্র দেখে পূর্বের সহজ সরল জীবনযাপনের সুখময় স্মৃতি স্মরণ করে তিনি ব্যক্ত করেছেন, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।

শাহ আব্দুল করিম তাঁর আরেকটি গানে বলেন:
“তত্ত্বগান গেয়ে গেলেন যারা মরমিকবি
আমি তুলে ধরি দেশের দু:খ-দুর্দশার ছবি
বিপন্ন মানুষের দাবী
গরীব চায় শান্তির বিধান।”

দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে গভীর তাঁর চিন্তাভাবনা! সমাজ তথা দেশের অধিকার বঞ্চিত অসহায় সাধারন মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে তিনি ভেবেছেন। তাই তিনি তাঁর গানের সুরে আওয়াজ তুলেছেন, দাবী জানিয়েছেন, চেয়েছেন অধিকার, চেয়েছেন শান্তির বিধান। সমাজবাদী চিন্তাধারার বাউল সাধক যেন গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাঁর গানের মাধ্যমে।

বাাউল করিম গান বেঁধেছেন:
“কোন্ মেস্তরী নাও বানাইলা
কেমন দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে ময়ূরপঙ্খী নাও।”
‘নৌকা’ শব্দের আঞ্চলিক শব্দ ‘নাও’। আর নাও শব্দটি এখানে তিনি রুপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। এর দ্বারা বুঝিয়েছেন দেহকে। তিনি সৃষ্টিকর্তার মহিমা কীর্তন করেছেন। কি সুন্দর ময়ূরপঙ্খী নাও স্বরুপ এই দেহ। আর যিনি সৃষ্টি করেছেন, না জানি তিনি কত সুন্দর!

তিনি তাঁর গানে বলেন:
“বাউল আব্দুল করিম বলে বুঝে উঠা দায়
কোথা হইতে আসে নাও
কোথায় চলে যায়?”

ভেবেছেন তিনি পার্থিব মানবজীবন নিয়ে। শুন্য হতে আসে মানুষ এই ধরাধামে! আবার চলে যায় বিলীন হয় সেই শুন্যের মাঝেই। সৃষ্টির এক অপার লীলা! অসীমের এই খেলা বুঝা দায় সসীমের পক্ষে। তাই যেন ব্যক্ত করেছেন তিনি তার গানে।

দেশপ্রেমের ভাবনা তাঁর মাঝে ছিল প্রখর। শুধুমাত্র আধাত্মিকতায় মোহাবিষ্ট না থেকে তিনি ভেবেছেন জন্মভূমিকে বাংলাকে নিয়ে। তিনি তাঁর ‘অামি বাংলা মায়ের ছেলে’ গানটিতে বর্ণনা করেছেন সবুজ শ্যামল বাংলার অপার রূপসৌন্দর্য। গানে প্রকাশ করেছেন, তিনি ধন্য হয়েছেন বাংলা মায়ের কুলে জন্ম নিয়ে। একজন চিন্তক দেশপ্রেমিক বাউল সাধকের সন্ধান পাই অামরা তাঁর গানে।

বহুমাত্রিক চিন্তাভাবনার অধিকারী বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম তার গানগুলোতে এভাবে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন বিষয়। সমাজ, দেশ, মানুষ, সৃষ্টিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, মানুষে মানুষে সহমর্মিতা সহনশীলতা সম্প্রীতি ইত্যাদি সকল বিষয় ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর বাউল গানের বাউল সুরে।

স্বশিক্ষায় শিক্ষিত সাধক বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম আমৃত্যু যে চিন্তাভাবনা লালন করেছেন আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ তা কতটুকু লালন করি অনুধাবন করি? বিষয়টি ব্যাখ্যা বা আত্মজিজ্ঞাসার দাবী রাখে বৈকি? তাঁর চিন্তাভাবনা যদি আমরা অনুধাবন করতে পারি তাহলে ব্যক্তি, সমাজ সর্বোপরি বাংলা ব-দ্বীপে সহমর্মিতা, সহনশীলতা, সম্প্রীতির সুবাতাস বইবে বলে বিশ্বাস করি। আজ ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সাধক বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ১৫তম প্রয়াণদিবস। বাংলা মায়ের কুলে জন্মেছিলেন বলেই আমরা পেয়েছি বাউল গানের বহুমাত্রিক এই সাধক পুরুষকে। যারা হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলার লোকসঙ্গীত। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মাঝে বাংলার মেটোসুরে। যে মেটোসুরে উচ্চারিত হবে সাধক পুরুষ বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের নাম যুগ থেকে যুগান্তে।

 

জিএন/এইচ

    ইমেইলঃ news.gouripurnews@gmail.com