দুই প্রকল্পে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়! বেড়েছে পৌরবাসীর ট্যাক্স; মিলেনি একফোঁটা পানি। এমন এক নগরীতে দু’টি প্রকল্পের সন্ধান মিলেছে। সেই পৌর নগরটি ময়মনসিংহের ‘ক’ ক্যাটাগরিভূক্ত ‘গৌরীপুর পৌরসভা।’ এ শহরে পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধিনে প্রথম ধাপে ব্যয় করা হয় ২ কোটি ৭লাখ ১৩হাজার ৫শ ৯০টাকা। আর দ্বিতীয় ধাপে ব্যয় হয় ২ কোটি ৮৬লাখ ৭হাজার ৯২০টাকা। পৌরসভার পাম্পচালক পদে দু’কর্মচারীর বেতন দেয়া হয়েছে বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকা। অবিশ^াস্য হলেও সত্য এই অর্থব্যয়ে শহরবাসীর ভাগ্যে জুটেনি ‘এক ফোঁটা’ পানি। জলের টাকা জলে গেছে!
দু’টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন করেছে ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।’ বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে প্রথম প্রকল্পটি ছিলো ২৩শহর পানি উন্নয়ন আর দ্বিতীয়টি হয়েছে ‘৪৫ পৌরসভা থানা সদর ও গ্রোথ সেন্টারে অবস্থিত পৌরসভা সমূহে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ও এনভায়মেন্টাল স্যানিটেশন (২য়পর্ব) প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠিত পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধিনে। প্রথম প্রকল্পটিই সচল হয়নি, জনমত জরীপ-পৌর পরিষদের মতামত ব্যতিরেখেই দ্বিতীয় প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। বিষয়টি নিশ্চিত করেন গৌরীপুর পৌরসভার উপপ্রকৌশলী মদন মোহন দাস। তিনি আরও বলেন, প্রকল্প অনুমোদন, অর্থায়ন, বাস্তবায়ন সবই করেছে ওই দপ্তর। পৌরসভার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি-ভাঙাচোরা করা হলেও দেয়া হয়নি কোনো ক্ষতিপূরণ। সচেতন নাগরিক সমাজের দাবি, দু’দফায় এ প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ লুট হয়েছে। জড়িতদের খোঁজে বের করে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হোক।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, দ্বিতীয় প্রকল্পটি ২০২০সনের ২০জুন গৌরীপুর পৌরসভার নিকট হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তর পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন স্থাপনা দেখাইয়া পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ম্যাপ, ৩টি পরীক্ষামূলক নলকূপ স্থাপন, ৩টি উৎপাদকমূলক নলকূপ স্থাপন, ৭.০৬ কিলোমিটার পাইপ লাইন ও ৭.১৮ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপন, সরকারপাড়া ও নিমতলীতে ২টি পাম্প হাউজ নির্মাণ, গোহাটায় ১টি পাম্প হাউজ নির্মাণ, ইন্টারকানেশন, ৩ সেট সাবমার্সিবল পাম্প এবং ৩ সেট ৫০ কেভি ক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরবরাহ ও স্থাপন এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থার তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ ছামিউল হক ও উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুল মান্নান খান এ প্রকল্পটি গৌরীপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ রফিকুল ইসলাম ও পৌরসভার উপ প্রকৌশলী মদন মোহন দাসের নিকট হস্তান্তর করেন।
এ প্রকল্পটি ২০১৫-১৬অর্থবৎসরে শুরু হয়। প্রকল্পে ৩টি পরীক্ষামূলক নলকূপ স্থাপনে ২লক্ষ ২৫হাজার ৯৯০টাকা, ৩টি উৎপাদনমূলক নলকূপ স্থানে ৬৯লাখ ৯৮হাজার ৯৬১টাকা, ২টি পাম্প হাউজ নির্মাণে ১৫লাখ ৪৩হাজার ৯০৬টাকা, ১টি পাম্প হাউজ নির্মাণে ১৫লাখ ৭১হাজার ৫০৬টাকা, ৩ সেট সাবমারসিবল পাম্প এবং ৩টি সেট ৫০ কেভি ক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরবরাহ ও স্থাপনে ৩৬লাখ ৮০হাজার ৯২৬টাকা, ৭.১৮ কি.মি পাইপ লাইন স্থাপনে ৬৭লাখ ৭৫হাজার ৮৮১টাকা, ৭.০৬ কি.মি পাইপ লাইন স্থাপনে ৬৬লাখ ৮০হাজার ৩৭৭টাকা, ইন্টারকানেশন ১১লাখ ৩০হাজার ৩৭৩টাকা ব্যয় হয়। যার মোট ব্যয় ২ কোটি ৮৬লাখ ৭হাজার ৯২০টাকা। প্রকল্পের অধিনে পৌরবাসীর দৌরগোড়ায় পানি পৌঁছে দিতে সতিষা খালপাড় ব্রিজ থেকে মেইন রোড পর্যন্ত ১০২৮.৬৭মিটার, গুজিখাঁ দানবাক্স পর্যন্ত ৫৮৬.২৭মিটার, খেলার মাঠ থেকে রেললাইন পর্যন্ত ৩১৩.৩৫ মিটার, গোলকপুর মোড় পর্যন্ত ১৩২৫.৩০ মিটার, সরকারি কলেজ পর্যন্ত ২৫৭.২০ মিটার, বালুয়াপাড়া মোড় থেকে রামগোপালপুর রোডে ২৯৫.৮৮ মিটার, শহিদ প্লাজা ৪৬৫.৫০ মিটার, কালিপর শহিদ প্লাজা থেকে বাঁশ মহাল পর্যন্ত ৬৪২.৩৪ মিটার, খেলার মাঠ ৩৮২.৯০ মিটার, আব্দুল হামিদ সড়কে ৪৪৬.৮৯ মিটার, নুরমহল থেকে আব্দুল আলী চেয়ারম্যানের বাসা পর্যন্ত ২৪৩.২৮ মিটার, ঘোষপাড়া গোরস্থান এলাকায় ১৮২.৮৬ মিটার, খাদ্যগুদাম রোডে ৪১৩.৯৪ মিটার, সরকারপাড়া থেকে পাটবাজার মোড় পর্যন্ত ৬৩৮.৫৬ মিটার, বাড়িওয়ালাপাড়া রোডে ৭৫.৩৪ মিটার পাস্টিক পাইপ, ব্রিজ ও কালভার্টে ৫৬.৮৪ জিআই পাইপ, সরকারপাড়া সড়কে ২০৩.১২ মিটার, ঘোষপাড়া মসজিদের দিকে ৮১৩.০৫ মিটার, সরকারপাড়া দানবাক্স এলাকায় ২২১.৮৫ মিটার, পূর্বভালুকা থেকে হাসপাতাল রোডে ১ কিলো ৪২৮.১৪ মিটার, হাসপাতালের সামনে থেকে পুরাতন পাম্প ৭২২.১৮ মিটার, নুরুল আমিন খান পাঠানের বাড়ির সামনের সড়কে ১৫৯.৩৯ মিটার, মুক্তিযোদ্ধা রফিক সড়কে ৭০২.০২ মিটার, গাঁওগৌরীপুর খালবাট থেকে নার্সারী পর্যন্ত ১ কিলোি ৩৬৫.৩৭ মিটার, চকপাড়া রেলওয়ে পানির ট্যাংকে ৩৫২.৩২ মিটার, রাইসমিলে ৩১০.৫৬ মিটার, বাড়িওয়ালাপাড়া মোড়ের দিকে ৫৮৬.১২ মিটার, পাটবাজার মোড়ে ১২৭.৭৩ মিটার, নিমতলী তিন রাস্তা মোড়ে ৩৯৬.১৫ মিটার প্লাস্টিক পাইপ, খালবাট ও ব্রিজে ১২৫.৪৩ মিটার জিআই পাইপ স্থাপন করা হয়েছে।
সরজমিনে এসব এলাকা ঘুরে কোথাও, প্রকল্পটি হস্তান্তরের ৪বছর অতিক্রম করলেও কোনো পরিবার বা প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের অধিনে পানি নেয়নি। পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধিনে স্থাপিত পাইপ লাইন থেকে খোদ গৌরীপুর পৌরসভার ভবনেও কোনো পানি সংযোগ পাওয়া যায়নি। বিশাল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলেও পৌর এলাকার কেউ এ প্রকল্পের ব্যয় সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানে না। প্রকৌশল অধিদপ্তরও জনসম্মুখে প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী প্রজেক্ট প্রোফাইল প্রকাশ করে নাই। অভিযোগ রয়েছে, অতিশয় গোপনে পৌর নাগরিকদের কোনোরূপ অবগতি না করেই পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় পাইপ স্থাপন করা হয়েছে। পাম্প হাউজগুলোতে যেসব পরিবার বসবাস করছেন, তারাও বিকল্প পানি ব্যবহার করছেন। সতিষার ইকবাল হাসান, পূর্বদাপুনিয়ার সুরুজ আলী, মধ্যবাজারের আইনুল হক জানান, কয়েক বছর আগে রাস্তার নিচে পাইপ বসাইতে দেখেছি। পানি বের হতে দেখি নাই।
এ প্রসঙ্গে গৌরীপুর পৌরসভার উপপ্রকৌশলী মদন মোহন দাস জানান, পরীক্ষামূলকভাবে ২শ পরিবারকে পানির সংযোগ দেয়া হয়েছিলো। দু’প্রকল্পের অধিনে ৫টি পাম্প হাউজ, প্রতিমাসে যেটাকা বিদ্যুৎ বিল আসে, তার ১০ভাগের একভাগও আয় আসে না। গ্রাহকরাও এ পানি ব্যবহারে আগ্রহী নয়, ফলে বন্ধ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারোয়ার হোসেনের নাম্বারে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেন নাই।
অপরদিকে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধিনে বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে ১৯৯৫-৯৬অর্থবৎসরে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় গৌরীপুর পৌরসভার পানি সরবরাহ প্রকল্প। তবে ২৭ বছরেও সেই প্রকল্পটিও চালু করতে পারেনি পৌরসভা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। মাটির নিচে ধ্বংস হয়ে গেছে প্রায় ২ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ক্রুটিপূর্ণ কাজ, অসমাপ্ত পাইপলাইন, পাম্প হাউজ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ১৯৯৭সনে পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক মুনসীর নিকট প্রকল্পটি হস্তান্তর করেন।
জানা যায়, গৌরীপুর পৌরসভা পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ১৯৯৫-৯৬অর্থ বৎসরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধিনে ২ কোটি ৭লাখ ১৩হাজার ৫শ ৯০টাকা ব্যয়ে ২৩ শহর পানি উন্নয়ন প্রকল্পের অধিনে ১৯৯৭সনে এর কাজ সমাপ্ত হয়। গৌরীপুর পৌরসভার বিপনী বিতান, অফিসপাড়াসহ পৌর এলাকায় ১৭ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন, ২টি পানির পাম্প অফিস নির্মাণ করা হয়। পানি সরবরাহের আওতায় শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার পথচারীদের জন্য দেয়া হয় মিনিকল। গৌরীপুর পৌরসভা এ প্রকল্প পরিচালনা করার জন্য পাম্পচালক পদে ২জন কর্মচারী নিয়োগ প্রদান করেন। ২৭বছরেও গৌরীপুর পৌরসভার পানি সরবরাহ প্রকল্প ত্রুটিমুক্ত করতে না পারায় মাটির নিচে পড়ে যন্ত্রাংশ মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। এ প্রকল্পের অধিনে গৌরীপুর পৌরসভা পাম্পচালক পদে রতন চৌহান ও আবু বক্কর সিদ্দিক নামে ২জন কর্মচারী নিয়োগ দেন। এ দু’জন কর্মচারীকে বেতন ও অন্যান্য খাতে ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে প্রতিবছর প্রায় ১০লক্ষ টাকার বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ সেবা না পেলেও পৌর নাগরিকদের ওপরও পানিসেবার ট্যাক্স চার্জ করা হয়েছে।
জিএন/আরইউ/এইচ
ইমেইলঃ news.gouripurnews@gmail.com